ঢাকা শহরের বন্যা ও জলাবদ্ধতা: টেকসই সমাধান সময়ের দাবি

বাহাউদ্দিন ফয়যী ]

ঢাকা শহর প্রায় প্রতি বছরই বন্যা ও জলাবদ্ধতার কবলে পড়ছে, যা শুধু জনজীবন নয়, দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি করছে। বর্ষা শুরু হলেই রাজধানীর বহু এলাকা পানিতে ডুবে যায়, ফলে মানুষের চলাচল ও দৈনন্দিন কাজকর্ম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।

এ সমস্যার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ, যেমন নগরায়নে অব্যবস্থাপনা, দুর্বল অবকাঠামো, পরিবেশ দূষণ ও প্রশাসনিক অকার্যকারিতা। দীর্ঘদিন ধরে নানা প্রকল্প ও পরিকল্পনা নেওয়া হলেও জলাবদ্ধতা নিরসনে বাস্তব পরিবর্তন খুব একটা চোখে পড়েনি। তাই এখন সময় এসেছে ঢাকার জন্য একটি টেকসই ও বাস্তবসম্মত সমাধান কাঠামো তৈরির।

ঢাকার ভৌগোলিক অবস্থান নিম্নভূমিতে হওয়ায় বর্ষার পানি সহজেই জমে থাকে। তবে শুধু ভূপ্রকৃতি নয়, মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডও এই সমস্যাকে ঘনীভূত করছে। রাজধানীর খাল ও নদীগুলো অবৈধ দখল ও দূষণের কারণে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। জলাধার ভরাট, অপরিকল্পিত নির্মাণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চরম অব্যবস্থাপনা পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করছে। প্লাস্টিক ও কঠিন বর্জ্যে খাল-নালা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বর্ষাকালে পানি বের হওয়ার পথ বন্ধ থাকে। ফলে পুরো শহর জলমগ্ন হয়ে পড়ে।

অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন ঢাকার বন্যার আরেকটি বড় কারণ। প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকা জনসংখ্যার চাপে শহরের আশপাশে গড়ে উঠছে বেআইনি ও অনিরাপদ বসতি, যেখানে পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। সংকুচিত রাস্তা, ভরাট খাল ও অনুপযুক্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থার ফলে বর্ষাকালে এসব এলাকায় তীব্র জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। নগর পরিকল্পনায় জলাধার ও জলাশয় সংরক্ষণের বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে, ফলে নতুন নির্মাণকাজ আরও সমস্যার সৃষ্টি করছে।

ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও নগর সরকার নানা প্রকল্প হাতে নিলেও অনেকক্ষেত্রে সেগুলো বাস্তবায়নের আগেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। পরিকল্পনার অভাব ও সঠিক তদারকির ঘাটতি প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট করে দিচ্ছে। প্রায়ই দেখা যায়, অনেক প্রকল্প অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে অথবা অনুমোদনের বাইরেও কিছু কার্যক্রম চালানো হচ্ছে, যার কারণে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। একই সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি ও স্থানীয় সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই সমস্যার সমাধানে সরকারের পাশপাশি নগরবাসীদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। খাল-নালা রক্ষা, বর্জ্য যথাযথভাবে নিষ্পত্তি এবং পরিবেশ সংরক্ষণে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য যেন খালে ফেলা না হয়, তা কঠোর নজরদারি ও আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে । একই সঙ্গে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নাগরিক অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা গেলে প্রশাসনিক কার্যকারিতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে।

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব এখন বাংলাদেশের শহরগুলোতেও স্পষ্ট। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে হঠাৎ ভারী বর্ষণ ও অপ্রত্যাশিত বন্যা পরিস্থিতি শহরের পরিকাঠামোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। তাই নগর পরিকল্পনায় জলবায়ু অভিযোজনের নীতি অবলম্বন করা জরুরি। পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও আধুনিক পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, জলাধার, জলাশয় ও পার্ক রক্ষার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

জলাবদ্ধতার কারণে শহরে স্বাস্থ্যঝুঁকিও ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ডায়রিয়া, টিটেনাস (ধনুষ্টঙ্কার) ও মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বর্ষাকালে অনেক বেশি দেখা যায়, যা শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। তাই স্যানিটেশন, পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, বিশেষত বর্ষার সময়, অত্যন্ত জরুরি।

ঢাকার জলাবদ্ধতা ও বন্যা সমস্যা নিরসনে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি প্রয়োজন প্রশাসনিক দক্ষতা ও জনসচেতনতার সমন্বিত উদ্যোগ। বেআইনি দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং স্থানীয় ও ওয়ার্ড পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করে সমস্যাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে সমাধান করতে হবে। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়হীনতা দূর করতে আন্তঃদপ্তর সমন্বয় কমিটি গঠন করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য।

পরিশেষে বলা যায় যে, ঢাকার জলাবদ্ধতা ও বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হলে অর্থনৈতিক ক্ষতি, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়বে। শহরের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ও ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুতেই এর প্রভাব পড়বে। তাই এখনই প্রয়োজন একটি সুপরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই নগর উন্নয়ন নীতি, যেখানে আধুনিক প্রযুক্তি, দক্ষ প্রশাসন ও সচেতন নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকবে। এই সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমেই ঢাকা শহরকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করে একটি নিরাপদ ও বাসযোগ্য নগরীতে পরিণত করা সম্ভব, যা দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Recent Posts

Bahauddin Foizee Written by:

বাহাউদ্দিন ফয়যী মূলত এশিয়া-প্যাসিফিক/ইন্দো-প্যাসিফিক এবং মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক। বিশ্বের বিভিন্ন থিংক-ট্যাংক ও গবেষণা-সংস্থার প্রকাশনায় প্রায়শ তার বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়ে থাকে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বিষয়ক কলামিস্ট হিসেবে তার কলাম/অপ-এড/মতামত বিশ্বব্যাপী বহু স্বনামধন্য পত্রিকায় ও প্রকাশনায় প্রতিনিয়তই প্রকাশিত হয়ে থাকে। ভূ-রাজনীতির পাশাপাশি বাহাউদ্দিন ফয়যী তার কলামগুলোতে পরিবেশ ও জলবায়ু-পরিবর্তন, শরণার্থী-সংকট ও অন্যান্য সামাজিক বিষয়াদি সম্পর্কেও লিখে থাকেন।