[ বাহাউদ্দিন ফয়যী ]
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল বর্তমানে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও কৌশলগত ভারসাম্যকে ঘিরে ক্রমবর্ধমানভাবে মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্বের দুই প্রধান শক্তি—যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা সরাসরি সংঘাতে রূপ না নিলেও, এর কৌশলগত প্রভাব গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতার ওপর গভীর ছাপ ফেলছে।
ভূ-কৌশলগত প্রেক্ষাপট
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলটি প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাংশ থেকে ভারত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। অঞ্চলটির মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ চীন সাগর, ভূরাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর মালাক্কা প্রণালী, ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রুট এবং বিশ্বের অনেক প্রধান অর্থনীতির দেশ। অঞ্চলটি বিশ্ব বাণিজ্য ও জ্বালানি প্রবাহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলে বিশ্ব বাণিজ্যের একটি বিশাল অংশ পরিচালিত হয় এবং একাধিক শক্তিধর রাষ্ট্রের কৌশলগত আগ্রহ এখানে কেন্দ্রীভূত।
চীন এই অঞ্চলে তার প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ” (বিআরআই) এবং “ম্যারিটাইম সিল্ক রোড”-এর মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র ও অংশীদারদের সঙ্গে “ফ্রি এন্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক” (এফওআইপি) কৌশলের মাধ্যমে এই অঞ্চলে একটি উন্মুক্ত ও নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা বজায় রাখতে চায়।
প্রতিরক্ষা ও সামরিক অবস্থান
দক্ষিণ চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ এবং সামরিক চৌকি স্থাপনের মাধ্যমে চীন সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করেছে। চীন ঐ অঞ্চলের প্রায় সম্পূর্ণ এলাকা নিজের বলে দাবি করে, যা প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে উত্তেজনার সৃষ্টি করছে। চীনের এই দাবীর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিত “ফ্রিডম অব নেভিগেশন” মিশনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জলপথে অবাধ চলাচলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। মার্কিন নৌবাহিনী এবং তার মিত্ররা এই অঞ্চলে সামরিক মহড়াও পরিচালনা করে থাকে।
এছাড়াও, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের সঙ্গে গঠিত ‘কোয়াড’ জোটকে যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তার ভিত্তি হিসেবে তুলে ধরছে। যদিও কোয়াড সরাসরি কোনো প্রতিরক্ষা জোট নয়, বরং এটি চীনের প্রভাব মোকাবিলায় একটি কৌশলগত জোট।
অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা
চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট। চীন তার আর্থিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোর অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করছে, যার ফলে চীনের উপর ঐ দেশগুলোর গভীর অর্থনৈতিক নির্ভরতা সৃষ্টি হচ্ছে। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (আইপিইএফ)-এর মাধ্যমে অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো চীনের বিনিয়োগ ও মার্কিন বাজারের প্রবেশাধিকার—উভয়কেই আলিঙ্গন করছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন বিরোধ ও প্রতিযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় এই দেশগুলো চাইছে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে এবং সামরিক সংঘাত এড়িয়ে চলতে।
কূটনৈতিক প্রচেষ্টা
যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দু’টি দেশই এই অঞ্চলে কূটনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশগুলো মিলে ‘আসিয়ান’ নামক যেই আঞ্চলিক জোট গঠন করেছিল, সেই জোট ও জোটভূক্ত দেশগুলোর সঙ্গে চীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক সফরের মাধ্যমে তার আসিয়ানভূক্ত পুরনো মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করছে এবং জোটের অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর সাথেও নতুন অংশীদারিত্ব গড়ে তুলছে।
বিশেষত ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া—এই দেশগুলো বর্তমানে উভয় শক্তির কূটনৈতিক কেন্দ্রে অবস্থান করছে। তারা চায় এমন একটি ভারসাম্য যেখানে কোন এক পক্ষের আধিপত্য ছাড়াই তারা নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে পারে।
ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। সরাসরি সংঘাতের সম্ভাবনা কম হলেও, ভুল বোঝাবুঝি, অনিচ্ছাকৃত সংঘর্ষ বা প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে পারে।
উভয় দেশ যদি আন্তর্জতিক আইন ও আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্বকে সম্মান করে, তবে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা একটি গঠনমূলক প্রতিযোগিতায় পরিণত হতে পারে। এতে করে অঞ্চলটির শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
উপসংহার
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিশ্ব রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি শুধুই শক্তির প্রদর্শনী নয়, বরং একটি কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ভারসাম্যের খেলা। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে কীভাবে আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করবে, সেটিই ভবিষ্যতের স্থিতিশীলতার মূল নির্ধারক হবে। তাই একটি নিরপেক্ষ, সংলাপনির্ভর ও সহযোগিতামূলক কৌশলই হতে পারে এই জটিল প্রতিযোগিতার উত্তম সমাধান।